বার্তা সংস্থা ইকনা: তবে এ কাহিনীর নায়ক আর ইয়াযিদরা নয়, বরং এ পিঠের নায়ক হলেন শহীদ সম্রাট ইমাম হুসাইন (আ.), তাঁর ভগ্নি হযরত যয়নাব এবং তাঁর ভাই হযরত আব্বাসরা, যাদেরকে নিয়ে বিশ্বমানবতা গৌরব করতে পারে। তাই কারবালা ঘটনার সমস্তটাই ট্রাজেডি বা বিষাদময় নয়। অবশ্য পৃথিবীতে বহু ঘটনাই ঘটেছে যেগুলোর কেবল একপিঠ রয়েছে অর্থাৎ এসব ঘটনা কেবলমাত্র দুঃখজনক ও শোকাবহ।
উদাহরণ হিসেবে বিংশ শতাব্দীর তথাকথিত সভ্যতার লালন ভূমি ইউরোপের এক দেশ 'বসিনয়ার' কথাই ধরা যাক কিংবা বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারের কথাই ধরা যাক-কেবল মুসলমানের গন্ধটুকু তাদের গায়ে থাকায় তাদের উপর চালানো হলো নির্মম গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, ঘর-বাড়ী ধ্বংস.... ইত্যাদি। তাদের অপরাধ শুধু এটুকু যে, তারা ছিল মুসলমান। আর এ জন্যেই এটি দুঃখজনক যে, বিশ্বে আজ এতগুলো নিরাপত্তা সংস্থা রয়েছে যারা কুকুরের উপরে অত্যাচার করাকেও নিন্দা করে, রয়েছে মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘ। অথচ এদের কোনটাকেই তোয়াক্কা না করে এক নিরস্ত্র-নিরীহ জাতিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চললো। কেউ তাদেরকে বাঁচাতে এগিয়ে এল না। তাই এ ঘটনা সত্যিই দুঃখজনক। কিন্তু এ ঘটনার এই একটিমাত্রই পিঠ আছে যা কেবল নৃশংসতা ও পাশবিকতায় ভরা।
কিন্তু কারবালাকে এভাবে বিচার করলে অবশ্যই ভুল হবে। এ ঘটনার একটি কালো অধ্যায় ছিল সত্য কিন্তু আরেকটি উজ্জ্বল অধ্যায়ও আছে। শুধু তাই নয়, এর উজ্জ্বল অধ্যায় কালো অধ্যায়ের চেয়ে শত-সহস্র গুণে ব্যাপক ও শ্রেষ্ঠ।
শহীদ সম্রাট ইমাম হুসাইন (আ.) আশুরার রাতে তার সঙ্গী-সাথীদেরকে প্রশংসা করে বলেন, ‘‘আমি পৃথিবীতে তোমাদের চেয়ে বিশ্বস্ত ও উত্তম কোনো সহযোগীর সন্ধান পাইনি।’’ ইমাম হুসাইন (আ.) কিন্তু বললেন না : নিরাপরাধ হওয়া সত্ত্বেও আগামীকাল তোমাদেরকে হত্যা করা হবে। বরং তিনি এমন এক সনদপত্র পেশ করলেন যার মাধ্যমে তাঁর সহযোগীরা বদরের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর (সা.) সহযোগীদের চেয়েও মর্যাদাসম্পন্ন হলেন, তাঁর পিতা হযরত আলী (আ.)-এর সহযোগীদের চেয়েও মর্যাদা-সম্পন্ন হলেন। আম্বিয়াদের যারা সাহায্য করেছেন তাদেরকে উদ্দেশ্য করে পবিত্র কুরআনে বলা হচ্ছেঃ
‘‘কত নবী যুদ্ধ করেছেন, তাদের সাথে বহু আল্লাহওয়ালা ছিল। আল্লাহর পথে তাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল তাতে তারা হীনবল হয়নি ও নতি স্বীকার করেনি। আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে পছন্দ করেন।’’ (আল ইমরানঃ ১৪৬)
অথচ ইমাম হুসাইন (আ.) প্রকারান্তরে তাঁর সহযোগীদেরকে আম্বিয়া-কেরামের এ সকল সহযোগীদের চেয়েও মর্যাদাসম্পন্ন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
কেউ যদি ইমাম হুসাইনের (আ.) মর্মান্তিক শাহাদাত উপলক্ষে শোক মিছিল করে, অথচ অমানুষ ইয়াযিদের নামের পাশে সম্মানসূচক নানান শব্দও ব্যাবহার করে থাকে-তাহলে সে কারবালা থেকে কোন শিক্ষাই নিতে পারল না। মহাপুরুষদের শ্রদ্ধা করা মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি । অভ্যাসকে বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা একান্তই বোকামি। কিন্তু মহাপুরুকে যেমন সম্মানভরে স্মরণ করা হয় তেমনি কাপুরুষকেও অবশ্যই ঘৃণা করা উচিত। কেননা, মহাপুরুষ ও কাপুরুষ উভয়কেই যদি আমরা শ্রদ্ধা করলাম-তাহলে হক আর বাতিলের মধ্যে আর কি-ই বা তফাৎ থাকলে? কাজেই, যে কেবল ইমাম হোসাইনের (আ.) মজলুমতাকে নিয়েই মূর্ছিত হবে সে যেমন ভুল করবে ঠিক তেমনিভাবে যে ইয়াজিদকে নায়ক বানিয়ে তার নামের পাশে সম্মানার্থক বিভিন্ন উপাধি ব্যাবহার করবে সেও একজন কাপুরুষকেই স্বীকৃতি দিল। যদিও আমরা সবাই ইমাম হোসাইনকেই (আ.) শ্রদ্ধা করি।
যে বৈশিষ্ট্য কোনো আন্দোলন ও বিদ্রোহকে মহান করে তা হলো এমন এক বিশেষ পরিস্থিতিতে এ আন্দোলন অনুষ্ঠিত হবে যখন কোনো মানুষ এর ধারণাও করতে পারে না। ঘন অন্ধকারের মধ্যে এক খণ্ড আলোর ঝলকানি, ব্যাপক জুলুম-স্বৈরাচারের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতার বজ্র আওয়াজ, চরম স্থবিরতার মধ্যে প্রকাণ্ড ধাক্কায় নিস্তব্ধ নিশ্চুপের মধ্যে হঠাৎ গর্জে ওঠা। উদাহরণস্বরূপ নমরুদের মতো একজন অত্যাচারী শোষক পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলে। কিন্তু আজীবন এ পিরিস্থিতি অব্যাহত থাকেনি। হঠাৎ করে একজন ইবরাহীমের (আ.) আবির্ভাব ঘটে ও নমরুদের কাল হয়ে দাঁড়ায়।
‘‘ইবরাহীম একাই এক অনুগত জাতি ছিলেন।’’ (নাহলঃ ১২০) তেমনি ফেরাউনের মতো একজন নির্দয় ও অহংকারীও রক্ষা পায়নি। কুরআনের ভাষায় :
‘‘ফেরাউন দেশে পরাক্রমশালী হয়েছিল এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে তাদেরকে সে হীনবল করেছিল। তাদের পুত্রদেরকে সে হত্যা করতো এবং নারীদেরকে সে জীবিত রাখত।’’ (কাসাস-৪)
কিন্তু এই পরাক্রমশালী ফেরাউনও টেকেনি। হঠাৎ করে একজন মূসা (আ) তার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন।
আরব যখন শোষণ-নিপীড়ন, মূর্তিপূজা, কন্যা সন্তানকে জীবিত হত্যা,রক্তপাত,দ্বন্দ-কলহ,ব্যভিচারে এবং অন্ধকারে ছেয়ে গেল তখন একজন মুহাম্মদের (সা.) আবির্ভাব হয় যিনি বলতে থাকেনঃ ‘‘বলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই,তবেই তোমরা সুখী হতে পার।”
স্বৈরাচারী উমাইয়া সরকার নিজ স্বার্থসিন্ধির জন্যে সব ধরনের সাজ-সরঞ্জামে সজ্জিত হয়েছিল, এমনকি ধর্মকে ভাঙিয়েও স্বৈরতন্ত্রের ভিত গাড়তে উদ্যত হয়, দুনিয়ালোভী হাদীস বর্ণনাকারীদেরকে টাকা দিয়ে কিনে তাদের সপক্ষে হাদীস জাল করার দায়িত্ব দেয়া হয়। বলা হয়,এক দরবারী আলেম বলেছিলঃ ‘‘ ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর নানার তেলোয়ারের আঘাতেই নিহত হয়েছেন।’’ একথার মাধ্যমে সে বলতে চেয়েছিল যে, ইমাম হোসাইনের (আ.) নানার ধর্মমতেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। বনি উমাইয়া ইসলামকে এমনভাবে তাদের শোষণ ও স্বৈরাচারের সেবায় নিয়োগ করতে পেরেছিল যে, একদল দুনিয়ালোভী ও নামমাত্র মুসলমানকে ইসলামী জিহাদের নামে ইমাম হোসাইনের (আ.) বিরুদ্ধে লিপ্ত করতে সক্ষম হয়। তারা ইমাম হুসাইনকে (আ.) হত্যা করতে পারার জন্যে শোকর আদায়স্বরূপ একাধিক মসজিদ নির্মাণ করে। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় যে, মানুষকে কিভাবে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল।
এ রকম এক বিপর্যয়ের মুহুর্তে ইমাম হুসাইন (আ.) মুক্তির মশাল জ্বালিয়ে এগিয়ে এলেন। যখন মানুষের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল, মানুষের মতামত প্রকাশের কোনো সাহস ছিল না। কোনো সত্যি কথা বলাও যখন কারও সাহসে কুলাতো না,এমন কি এর কোনো প্রতিরোধ অবাস্তবে পরিণত হয়-ঠিক সে মুহুর্তে ইমাম হোসাইন (আ.) বীরদর্পে বিরোধিতায় নামলেন, বজ্রকন্ঠে সত্যবাণীর স্লোগান তুলে দুনিয়া কাঁপিয়ে দিলেন। খোদাদ্রোহী স্বৈরাচারের মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দিলেন। আর এ কারণেই তাঁর আন্দোলন মহিমা লাভ করেছে। তাঁর আন্দোলন কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে যুগ-যুগান্তরের মুক্তিকামী ও সত্যান্বেষী মানুষের জন্যে অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছে। পার্সটুডে