IQNA

জাতিসংঘের সামনে জটিল হিসাব

মিয়ানমারের আসল সরকার কোনটি

0:03 - September 06, 2021
সংবাদ: 3470621
তেহরান (ইকনা): কোনটি মিয়ানমারের আসল সরকার? নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে যে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে সরকার গঠন করেছে তারা, না কি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সর্বদলীয় জাতীয় ঐক্যের সরকার—এমন জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি জাতিসংঘ। বিষয়টি সুরাহা হতে হবে আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশন শুরুর আগেই।

মিয়ানমারের জান্তা যেভাবে ক্ষমতা দখল করেছে, তা বিশ্ব গ্রহণ করেনি। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, আধুনিক বিশ্বে সামরিক অভ্যুত্থানের স্থান নেই।

মিয়ানমারের প্রকৃত সরকার হিসেবে দাবি করা দেশটির উত্খাত হওয়া সরকার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সর্বদলীয় জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনএইজি)।

অং সান সু চিকে স্টেট কাউন্সেলর হিসেবে রেখে গঠিত ওই সরকারটি মূলত প্রবাসী সরকার। ওই সরকারের মন্ত্রী, কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে অভিহিত করে মামলা দিয়েছে জান্তা। মিয়ানমারের বাইরে থেকেই দায়িত্ব পালন করছে ওই সরকার। মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় চলমান আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নেওয়া জনগণের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ আছে।

আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের উদ্যোগে গঠিত মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ পরামর্শক কমিশনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বৈধতার প্রশ্নে এনইউজিকে এগিয়ে রেখেছে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, প্রকারান্তরে বৈধতার প্রশ্নটি আসবে জাতিসংঘে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত নিয়োগের এখতিয়ার নিয়ে। এনইউজি চাইবে জাতিসংঘে মিয়ানমারের বর্তমান রাষ্ট্রদূতকেই বহাল রাখতে। কারণ ওই রাষ্ট্রদূত সু চির সরকারের সময় নিয়োগ পেয়েছেন। জাতিসংঘে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি জান্তার বিরোধিতা করছেন। অন্যদিকে জান্তা চাইবে তার অনুগত কাউকে নিয়োগ দিতে। এই নিয়োগ দিতে পারা এবং জাতিসংঘে তা গৃহীত হওয়া জান্তার এখতিয়ারের স্বীকৃতি বলে ধরা হবে। এটি কার্যত মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ হিসেবে জান্তার স্বীকৃতি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, যে ক্রেডেনশিয়াল কমিটি মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেবে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি চীন, রাশিয়াও থাকবে। ফলে বিষয়টির সমাধান খুব সহজ নাও হতে পারে। চীন ও রাশিয়া এরই মধ্যে মিয়ানমারের জান্তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে ও সফর বিনিময় করছে।

মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ পরামর্শক কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, নতুন কোনো সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রশ্নে সাধারণত তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। এগুলো হলো রাষ্ট্রের ওপর ওই সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ, গণতান্ত্রিক বৈধতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি তার আনুগত্য বা অঙ্গীকার। মিয়ানমারের জান্তার কোনো গণতান্ত্রিক বৈধতা নেই। তারা নির্বাচিত নয়। নিজেরাই নিজেদের নিয়োগ দিয়েছে। জান্তা অব্যাহতভাবে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইন ও মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে চলেছে।

অন্যদিকে এনইউজির উল্লেখযোগ্য মাত্রায় গণতান্ত্রিক বৈধতা আছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যদের দিয়ে ওই সরকার গঠিত হয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি জোরালো অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।

রাষ্ট্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোর ওপর জান্তার নিয়ন্ত্রণ আছে। মিয়ানমারের বড় শহরগুলোতে জান্তার জোরালো উপস্থিতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধও জোরালো। পুরো দেশের ওপর জান্তার কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই। তা ছাড়া জান্তা জনগণের মৌলিক অধিকার পূরণ করতে পারছে না এবং পূরণ করতে চায় এমন আগ্রহও দেখায়নি।

অন্যদিকে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে এনইউজির নিয়ন্ত্রণ আছে। নৃগোষ্ঠীভিত্তিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে জনগণকে সেবা দেওয়ার পথ বের করার চেষ্টা জোরালো করেছে এনইউজি।

মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ পরামর্শক কমিশনের বিশ্লেষকদের ধারণা, রাষ্ট্রগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে রাজনৈতিকভাবে বিশ্লেষণ করে মিয়ানমারের সরকার প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে তাদের দৃষ্টিতে এনইউজি মিয়ানমারের আসল সরকার হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির শর্ত পূরণ করেছে।

নির্বাচিত সরকারকে উত্খাত করে ক্ষমতা দখলকারী জান্তাকে স্বীকৃতি না দেওয়ার নজির আছে জাতিসংঘে। সাধারণ পরিষদ ১৯৯২ সালে হাইতিতে এবং ১৯৯৭ সালে সিয়েরা লিওনে সামরিক জান্তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। সিয়েরা লিওনের ক্ষেত্রে উত্খাত হওয়া সরকারের প্রতিনিধির ‘অ্যাক্রিডিটেশন’ গ্রহণ করেছিল সাধারণ পরিষদ।

আবার এ ধরনের জটিলতার ক্ষেত্রে দেরি করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নজিরও আছে ক্রেডেনশিয়াল কমিটির সামনে। ১৯৯৩ সালে গঠিত কম্বোডিয়ার জোট সরকারের শরিকদের সামরিক শক্তি ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন হুন সেন। ওই সরকারের রাষ্ট্রদূতকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া পিছিয়ে দিয়েছিল এই কমিটি।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গত ১৪ জুন মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে ১১৬-১ ভোটে। ওই প্রস্তাবে মিয়ানমারের জান্তাকে ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রতিফলিত জনগণের ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে জান্তাকে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত পার্লামেন্ট খুলে দিতে বলা হয়েছে। কালের কণ্ঠ

captcha